গুপ্ত-যুগের শিল্প নিদর্শনাদির মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী হচ্ছে অজন্তার চিত্রমালা। এটি ধ্রুপদী চিত্রকলার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়-কাটা ধর্ম মন্দিরে- এই সমস্ত চিত্রের নমুনা আবিষ্কৃত হয়েছে। এরমধ্যে অনেকগুলি আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে কালের করাল গ্রাসে। অজন্তার এই গুহাগুলির সংখ্যা প্রায় তিরিশ। পূর্ব-পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ছয় মিটার। প্রায় উল্লম্ব পাহাড়ের মধ্যে এগুলি অবস্থিত। মাঝখানে আছে দু’টি চৈত্য (৯ ও ১০ নং) এবং তাদের সহযোগী বিহার (৮, ১২ ও ১৩ নং) । এই গুহাগুলি, অজন্তার গুহা বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। এগুলির বয়স খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে। পুরাতন ছবিগুলো টিকে আছে ১নং গুহার নাম ও শেষের দেয়ালে এবং ১০নং গুহার বাম ও ডানের দেয়ালে। ১০নং গুহার ডান দিকের দেখালে আঁকা হয়েছে “শ্যামা” শাদ্দান্ত জাতকের কাহিনী। এটি বুদ্ধের পূর্ব জন্মের ইতিকথা যা খুবই জনপ্রিয় ছিল। এই কাহিনীগুলি ধারাবাহিকভাবে আঁকা হয়েছে সাঁচীর স্তূপের রেলিঙে কিংবা অমরাবতীর মহান স্তূপের গায়ে। এই চিত্রাবলীর ধারাবাহিকতা অবশ্য মাঝে মাঝে ক্ষুণ্ন হয়েছে কখনো কোনো গাছ, দালান বা পাথরের চাঁই-এর অবস্থানের কারণে। ছবির অনেক কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও যা অবশিষ্ট আছে তা থেকে বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না যে এগুলো ১৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী যুগের অমরাবতীর ভাস্কর্যের আদলে নির্মিত। রঙের ব্যবহার সীমিত। যেমন লাল, ‘অকার’ হলুদ (Yellow ochre), মেটে সবুজ (টেরাভার্ট), ভূষা কালো এবং চুনের সাদা।
অজন্তা চিত্রে রেখার ব্যবহার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ছন্দময় ও গতিময় রেখার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। এগুলির সাথে তৃতীয় শতকের অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনকোন্ডার পাথরের ভাস্কর্যের প্রাথমিক স্কেচের রেখার অনেক সাদৃশ্য আছে এছাড়া অজস্তা চিত্রে আমরা ভাবপ্রকাশের সফলতা করি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় “অজ্ঞান হয়ে যাওয়া রাণী”র চিত্রটি। এই সময়কার চিত্রে কিন্তু এই রীতির সূচ হয়। এর পূর্বে নিশ্চয়ই দীর্ঘ দিনের অনুশীলন ছিল। তা না হলে এত উন্নত চিত্র কৌশল আয়ত্ব করা সম্ভবপর হতো না ।
১০ নং গুহার একটি খণ্ডিত অংশে যে চিত্র রয়েছে সেটি এরকম। একজন সুদর্শন রাজা তাঁর অনুচরবর্গকে নিয়ে একটি মালা পরিহিত বৃক্ষের দিকে আগুয়ান। সেখানে অপেক্ষা করছে একদল সঙ্গীতজ্ঞ ও নর্তকী। রাজা সদলবলে সেদিকে যাচ্ছেন। এ প্যানেলটি বাম থেকে ডানে বিস্তৃত। এ চিত্রের বাস্ততায় যে-কোনো দর্শকই অভিভূত হবেন। প্রতিটি ব্যক্তির চেহারায় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বর্তমান। বিশেষ করে গোফওয়ালা রাজার চেহারা। তিনি যে শুধু একজন সুপুরুষ ব্যক্তি তাই নন, তাঁর চুলের ভূষণ মণিমুক্তা দ্বারা সজ্জিত। ছবির ডান দিকের অংশে লম্বা শিঙা হাতে দু’জন সঙ্গীতজ্ঞ, আর নিচের সারিতে দু’জন নর্তকীকে প্রাণবন্ত ভঙ্গীমায় দেখা যাচ্ছে। তাদের চোখে মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি।
পরবর্তী ছবিগুলো সমগ্র দেয়াল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। সবসময়ই এগুলো কাহিনী বলে যাওয়ার চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয় নি। বরং প্রচুর জনমানুষের ভিড়ে তা যেন আরো রঞ্জিত আরো স্পন্দিত হয়েছে। অবশ্য এই গতি আর স্পন্দন কখনো কখনো বাধাগ্রস্ত হয়েছে স্থাপত্যের কারণে। কখনো বা অদ্ভুত কিউবিস্ট ধরনের গড়ন এই বাধার সৃষ্টি করেছে।
১নং গুহাটি পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত একটি বিহার। গুপ্ত-যুগে সম্পূর্ণ পাহাড় কেটে যে স্থাপত্য নির্মিত হতো এটি তার একটি নিদর্শন। এই গুহাটি বৌদ্ধ শিল্পকলার যাদুঘর বললে অত্যুক্তি হয় না। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর বৌদ্ধ বিহারগুলো যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আবাসগৃহ এবং উপাসনার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখানে একটি বুদ্ধ মূর্তিও আছে। ১নং গুহার চিত্রসমূহের গুণগত মান অত্যন্ত উন্নত। এখন পর্যন্ত এই সমস্ত ছবির উজ্জ্বলতা আমাদের মুগ্ধ করে। এ ছাড়া এই সমস্ত ছবি থেকে আমরা পঞ্চম শতাব্দীর শেষপাদের জটিল বৌদ্ধ সমাজের এক স্বরূপ আবিষ্কার করতে পারি।
এ ছাড়াও বর্তমানে টিকে থাকা অজন্তা চিত্রের মধ্যে আছে বুদ্ধের জীবন ও জাতকের কাহিনী। সমস্ত চিত্র জুড়ে আছে জীবন, আছে ছন্দ গতি আর ক্যালিগ্রাফিক রেখা। অজন্তা চিত্রে মানুষের হাতের মুদ্রা বা অভিব্যক্তি দেখার মতো ।
এ ছাড়াও বর্তমানে টিকে থাকা অজন্তা চিত্রের মধ্যে আছে বুদ্ধের জীবন ও জাতকের কাহিনী। সমস্ত চিত্র জুড়ে আছে জীবন, আছে ছন্দ গতি আর ক্যালিগ্রাফিক রেখা। অজন্তা চিত্রে মানুষের হাতের মুদ্রা বা অভিব্যক্তি দেখার মতো ।
বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণির কথাই ধরা যাক। এটি অজন্তার একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। এখানে ফিগারটি ত্রিভঙ্গমূর্তিতে দণ্ডায়মান। হাতে তাঁর নীলপদ্ম, যা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে আঁকা। গায়ে মণিমাণিক্যখচিত অলঙ্কার। গায়ে রয়েছে উচ্চবর্ণের পরিচারক পৈত্য। এখানে বুদ্ধকে এক শান্ত-সৌম্য আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যিনি মায়াময় ধরণীর উর্ধ্বে। ছবিতে কোনো ছায়া নেই। সম্ভবত গুহার অন্ধকারকে দূর করার জন্য এটি করা হতে পারে। আবার অপার্থিব পরিবেশ আনার জন্যও তা হতে পারে। বিশেষ টেকনিক ব্যবহারের ফলেই এতে এক ধরনের দ্যুতি বিদ্যমান ।
অজন্তার ১নং গুহার আর একটি সুন্দর বোধিসত্ত্ব ফিগার আছে। এখানে তিনি রানী ও মহিলা পরিবেষ্টিত অবস্থায় উপস্থাপিত। এখানে মহাজানক জাতকের কাহিনী নতুনভাবে অবতারণা করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজপ্রাসাদের চিত্রটি যে ভাবে আঁকা হয়েছে তাতে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।
আর একটি সুন্দর ছবি হলো পদ্মপুকুরে শ্বেতহস্তী। অজন্তার ছাদের প্যানেলে যে সমস্ত ছবি আঁকা হয়েছে এটি তার মধ্যে একটি। এ ছাড়া শত প্রাণী যেমন ষাঁড়, ঘোড়া, পাখি, বানর ইত্যাদিও আঁকা হয়েছে সুন্দরভাবে। এ-সমস্ত ছবির বুনুনি আমাদের অবাক করে দেয়।
১৭নং গুহার ছবি হচ্ছে পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ের। এই ছবিতে যে-সমস্ত মটিফ ব্যবহৃত হয়েছে তা ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত রাজপুত অনুচিত্রে দেখতে পাই। এ ছবিতে আমরা দেখি স্থাপত্যের সেটিং-এর মধ্যে প্রেমিক যুগলকে আঁকা হয়েছে। এটিতে “সিংহল অবদান”-এর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কাহিনীটি এরকম :
এক ধনী বণিকের জাহাজ একটি দ্বীপের কাছে ডুবে যায়। সেই দ্বীপে বাস করত একদল মানবী। দিনের বেলা এরা সুন্দরী নারীর বেশে থাকত। কিন্তু রাতের বেলায় তারা হয়ে উঠতো নরমাংসভোজী জীব। ছবির একটি অংশে এই নায়ককে এরকম এক নারীবেশী দানবীর পাশে দেখা যাচ্ছে।
এ ছাড়া এ জাতীয় অপর একটি কাহিনীর বর্ণনা আমরা অজন্তার এই চিত্রে দেখতে পাই। এটিও বিশ্বস্তর জাতকে বর্ণিত। এ ছবিতে যে যৌন আবেদন প্রস্ফুটিত হয়েছে তা পরবর্তীকালের ভারতীয় অনুচিত্রে আমরা দেখতে পাই। এছাড়া পঞ্চম শতাব্দীতে অঙ্কিত এ-সমস্ত চিত্রে তৎকালীন ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শনও আমাদের চোখে পড়ে। এইসব স্থাপত্যের স্তম্ভের উপরিভাগ ছিল চ্যাপ্টা কুশানীকৃতির। এগুলো মণিমাণিক্যখচিত
ছিল। ১৯ নং গুহার প্রবেশ পথে অবশ্য এরকম স্তম্ভ আছে। তার বাম পাশে দু’টি নর ও নারী মূর্তি খোদিত আছে। এ দু’টি হচ্ছে নাগরাজ ও নাগরানী। অনেকটা যক্ষ ও যক্ষীর অনুরূপ। অতি প্রাচীন কাল থেকেই এ উপমহাদেশে যক্ষীমূর্তি প্রজননের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এক নাগরাজা ও নাগরাণী বৌদ্ধধর্মের পবিত্র স্থানটিকে পাহারা দিচ্ছে। দু’জনেই সহজ বসার ভঙ্গীতে উপবিষ্ট। ডান পা-টি উপরে উঠিয়ে শরীরের সাথে সন্নিবেষ্টিত। বাম পা মাটিতে ঝুলে আছে। মাথার পিছনে রয়েছে বহু মাথা বিশিষ্ট এক সাপ যা অনেকটা প্রভামণ্ডলের আকার সৃষ্টি করেছে।
১৯নং গুহার সম্মুখভাগটি গুপ্ত রীতিতে নির্মিত চৈত্য বা বিহারের অনুরূপ। এর সম্মুখভাগে প্রচুর পরিমাণে বুদ্ধমূর্তি খোদাই করা হয়েছে। এ থেকে এই ধারণাই হয় হে এই সময় বৌদ্ধ মহাযানতন্ত্র ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করেছিল। সুঙ্গ যুগে অবশ্য এরকমটি ছিল না। বৌদ্ধমূর্তির সাথে ব্রাহ্মণ্য মূর্তির সমাবেশ থেকে এটিই ধারণা করা হয় যে হিন্দু দেবদেবী ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধধর্মে অনুপ্রবেশ করেছিল। এটি ক্রমে বৌদ্ধধর্মের প্রতি এক চ্যালেঞ্জ রূপে দেখা দেয়। প্রায় এক শতাব্দী পরে ইউরোপে যেমন ক্যাথলিক ধর্মমতের সাথে সংস্কারবাদীদের সংঘাত বাধে, তেমনটি ঘটনা এখানে ঘটেছিল। বৌদ্ধধর্ম এক ধরনের গুহ্যতান্ত্রিক রূপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করল। ক্রমান্বয়ে হিন্দুধর্মের সাথে মিশ্রিত হয়ে বৌদ্ধধর্মের এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে এই দুই ধর্মের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। অবশেষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে এসে যখন এই উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ঘটল তখন বৌদ্ধধর্মের ক্ষীণ প্রবাহটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল।
তথসুত্রঃ
*বিশ্ব সভ্যতা অ শিল্পকলা
*Wikipedia
Author: Sumon Sutro Dhar
This Platform Is Created To Support All Art Activity In Bangladesh.