মহেশখালী-ইউনান প্রদেশঃ শিল্পী মং মং সো এর যাত্রা

শিল্পী মং মং সো। যার শৈশব থেকে কৈশোরের বড় হয়ে উঠা, দৃশ্য শিল্প জগতের সাথে যাত্রা শুরু করা, সব কিছুর সাথে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে মাঝি মল্লা, নৌকা,ট্রলার এইসকল বিষয়বস্তুর। সমুদ্রের বুক আছাড়ের পর আছাড় খেয়ে খেয়ে জাহাজগুলো যখন তীরে ফিরে বিশ্রাম নিত, তখন সেসব ্ট্রলার, কাদা বালি এইসবি হয়ে উঠতো শিল্পীর শৈশবের খেলার উপাদান। শিল্পীর জলরং চর্চার সাথে ও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে এইসকল বিষয়বস্তুর।

শিল্পী মং মং সো মহেশখালী ও বান্দরবানে তার পড়া লেখার পাঠ শেষ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, চারুকলা বিভাগে। শিল্পীর জল রং এর প্রতি আগ্রহ, প্রেম আগে থেকেই ছিলো, এবং তা আরো প্রকট হতে থাকে চট্টগ্রামে আসার পর। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান, প্রাকৃতিক নৈশর্গ্যের ছবি শিল্পীর জলরং এ মূর্তমান হতে থাকে একের পর এক। এরপর শিল্পী মং মং সো’ পাড়ি জমান সদূর চীনের ইউনান প্রদেশে। চীন সরকারের দ্বারা প্রাপ্ত স্কলারশিপে ভর্তি হন ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটিতে। পরবর্তীতে শিল্পীর জ্ঞানতাত্ত্বিক শিল্পচর্চা, জলরং এর নতুন নতুন টেকনিকের চর্চা সব কিছুর যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। শিল্পীর ‘Songs of Fisherman’ সিরিজের চিত্রকর্মগুলো নির্মিত হয়েছে শিল্পীর ইউনান ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স-এ শিক্ষাকালীন সময়ে, এবং তা প্রদর্শিত হয় ২০১৯ সালে ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটির গ্যালারীতে।

পরবর্তীতে এই সিরিজের কাজ গুলো দেখতে পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক কোন প্রতিযোগীতায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্যালারি কিংবা কোন গ্রুপ এক্সিবিশনে। তারই ধারাবাহিকতায়, কিছুদিন আগে EMK Center এ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো, শিল্পীর এই সিরিজের আরো একটি প্রদর্শনী।

শিল্পী মং মং সো জলরং এ স্বিদ্ধহস্ত। তার শিল্পচর্চার একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে রয়েছে জলরং এ কাজ করার অভিজ্ঞতা, যা তাকে করে তুলেছে আরো নিপুণ।। চীনে থাকাকলীন সময়ে তিনি মাস্টার্স/এমফিল সম্পন্ন করেছেন জলরং এর উপর। বর্তমান সময়ে জলরং এ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছেন লিওয়ের অধীনে তিনি শিল্পশিক্ষা লাভ করেন। তার ব্যবহৃত জল রঙ এর টেকনিকের প্রভাব শিল্পী মং মং সো-র কাজে দৃশ্যমান। শিল্পী মং মং সো-এর জলরং এর প্রায়োগিক দিক খেয়াল করলে দেখা যায়, শিল্পী কাগজের প্রতিটা টেক্সারটাকে ধরে রেখে কাজ করেন। কাগজের প্রতিটা বুনট ধরা পড়ে তার কাজে। জলরং এ পরিমিত ওয়াশের পাশাপাশি রয়েছে, প্রতিটা বিষয়বস্তুকে পরিমিতভাবে ফুটিয়ে তুলার দক্ষতা। বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে জলরং এর প্রতি যে আগ্রহ ও ভালোবাসা জন্ম নিয়েছলো, তাই পরবর্তীতে হয়েছে আরো বিস্তৃত এবং নিত্য-নতুন কলা কৌশল রপ্ত করার শিল্পীর সহজাত প্রবৃত্তি তাকে করেছে আরো প্রক্ষর ও তিক্ষ্ণ। শিল্পী জলরং এর প্রতিটা ওয়াশ, দাগ, রেখাকে যেন আলাদা আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত রূপে।

শিল্পী মং মং সো এর বিষয়বস্তু নির্বাচন, বস্তুর দৃশ্যায়ন চিত্রগুলোকে দিয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্রতা। চীনে গিয়ে রপ্ত করা জলরং এর টেকনিকের সাথে রয়েছে এই দেশের, এই মাটির জেলেদের কঠিন জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। শিল্পী ছেন লিও  মং মং সো এর এই সিরিজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মং মং সো এর করা ওয়াটারকালারগুলো দেখে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, চীনের কোন শিল্পীর করা কাজ। কিন্তু তার বিষয়বস্তুগুলো দেখার পর বুঝতে পারলাম এবং আগ্রহী হয়ে পড়লাম শিল্পীর কাজের এইসব বিষয়বস্তু নিয়ে। শিল্পী অলক রায় (সাবেক প্রফেসর, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, ‘মং মং সো এর জলরং করার টেকনিক চীনের শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত হলেও, তার বিষয়বস্তু এই মাটির। শিল্পী পাবলো পকাসো যেমন সদূর প্যারিসে থেকেও ছিলেন একজন স্পেনিয়ার্ড’। Songs of fishermen সিরিজের কাজগুলোতে ট্রলারগুলোর কম্পোজিশন লক্ষ্যণীয়। প্রতিটা ছবিতে যেন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত  ট্রলারগুলো ছবির প্রাণ। 

শিল্পী মং মং সো তার শিল্পভাষা নির্মাণের জন্য মাধ্যম হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন জলরংকে। এই মাধ্যমের উপর তার দক্ষতা প্রশংশনীয়। তার সাথে শিল্পী মং মং সো এর বিষয়বস্তু নির্বাচন তাকে দিয়েছে এক শৈল্পিক স্বকীয়তা। শিল্পী মং মং সো বলেন, ‘শিল্প চর্চার শেষদিন পর্যন্ত তিনি জলরং চর্চা করে যেতে চান’। তাই এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জলরং চর্চায় শিল্পী মং মং সো যুক্ত করবে আরো দারুণ দারুণ সব চারু দক্ষতা এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যতা।

শান্তনু চৌধুরী

স্বাধীন লেখক,চট্টগ্রাম।

One Reply to “মহেশখালী-ইউনান প্রদেশঃ শিল্পী মং মং সো এর যাত্রা”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *