সি আর বি তে চিত্রপ্রদর্শনী-শিল্পে প্রতিবাদ ও এর প্রভাব

চট্টগ্রাম শহরের সিআরবি-তে হাসপাতাল করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই, চট্টগ্রামবাসী সিআরবি-র শিরীষতলা প্রাঙ্গনে আন্দোলন করে আসছে হাসপাতাল না হওয়ার বিপক্ষে। সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-উপদল, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিল্পী, সবাই এই দাবীতে একমত যে, কোন কিছুর বিনিময়ে সিআরবি-তে হাসপাতাল হতে দেয়া যাবে না। বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার দরূণ, শিল্পায়নের যে প্রভাব পড়েছে এই বন্দর নগরীতে, তারই ফলশ্রুতিতে বিগত বেশ কিছু বছরে নগরকেন্দ্রিক প্রয়োজনীতার দরুণ দখল করে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান। কিন্তু, সিআরবি-র স্থানিক তাতপর্য বিবেচনায়, সিআরবি-তে হাসপাতাল ঘোষণা দেয়ার পর থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে সিআরবি তে হাসপাতাল বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। যখনই কোন আন্দোলন, সংগ্রাম, বিক্ষোভ, প্রতিবাদের জন্ম হয়, তখনি শিল্পীদের শৈল্পিক অবস্থান সেই ঘটনাগুলোকে আরো তরান্বিত করে তুলে। তাদের গান, কবিতা, রং-তুলির ছোঁয়া সাধারণ মানুষকে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলে বিষয়গুলো নিয়ে। সিআরবি-তে যে আন্দোলন, প্রতিবাদ হচ্ছে, মূলত এই আর্ট ক্যাম্পে অঙ্কিত শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শীত হয় সিআরবি-র শিরীষতলায়, যার শিরোনাম ‘শিল্পীর ভাবনায় সি আর বি’। ২৩-২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত ছিলো সাধারণ মানুষজনের জন্য। এই প্রদর্শনীটিতে অংশগ্রহণ করেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের, চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। এবং প্রদর্শনীটির কিউরেশন করেন, চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য্য বিভাগের সাবেক অধ্যক্ষ শিল্পী অলক রায়।

প্রদর্শনীটিতে শিল্পীরা ছবি ও পারফর্ম্যান্স আর্টের মাধ্যমে তাদের মনের ভাবনাগুলো প্রকাশ করেন। শিল্পীদের চিত্রকর্মগুলোর বিষয়বস্তুতে সিআরবি, পরিবেশ-প্রকৃতি, বৃক্ষ সহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় উঠে আসে। শিল্পি মং মং সোর ‘সি আর বি-র নীরবতা’ শিরোনামের ছবিটিতে সি আর বি এর একটি বাস্তববাদী চিত্র ফুটে উঠে। যেখানে শিল্পীর তার নিবিড় তুলির আঁচড়ে সিআরবি-র চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। আর্ট ক্যম্পটি সম্পর্কে প্রদর্শনীর কিউরেটর শিল্পী অলক রায় বলেন, ‘চট্টগ্রামের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার যাত্রাকাল থেকেই সিআরবি প্রাঙ্গন ছাত্র-শিক্ষার্থীদের দৃশ্যশিল্প চর্চার একটি প্রিয় স্থান। তাই চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টনী অটুট রাখার দাবিতে সি আর বি’কে ঘিরে আমরা শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের প্রাণের আকুতি প্রকাশ করতে চেয়েছি’। শিল্পী সঞ্জয় দাশের শিল্পকর্মে দেখা যায়, তিনি কিউবিস্ট ঘরানায় সি আর বির দৃশ্যপটকে কল্পনা করে এক ধরণের ছবি এঁকেছেন। তার চিত্রকর্মে শুয়ে থাকা মানুষের চিত্রটি মনে করিয়ে দেয়, এই সিআরবি-র শতবর্ষয় বৃক্ষগুলো এর ছায়া কত মানুষের বিশ্রামের আশ্রয়স্থল।

প্রদর্শনীতে দর্শনরত এক দর্শক বলেন, ‘সিআরবি চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। এই দৃশ্যগুলো আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সিআরবি-র স্থানিক তাতপর্য্য কতটা, এবং শিল্পীদের আঁকা এই ছবিগুলোতে তাদের যে আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে তা আমাদের হৃদয়কে ও তাড়িত করছে। এবং আমরা বুঝতে পারছি, মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা কিছু নয়’। শিল্পী নিলুফার চামান প্রদর্শনী প্রসঙ্গে বলেন, ‘মানুষ এখানে আসছে, ছবি গুলো দেখছে। ছবিগুলো দেখার পর তাদের নিজেদের মধ্য একধরণের উপলব্ধি হচ্ছে। এই কাজ-ই শিল্পীরা করে থাকে, তারা দর্শকের অনুভূতিতে নাড়া দেয়। শিল্পীরা সমাজের বাইরের কেউ নয়। তারা সমাজের-ই অংশ। সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা শিল্পীদের বিবেককেও নাড়া দেয়। এবং এই উপলব্ধিটা দর্শকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াটাই শিল্পীদের কাজ’।

শিল্পীদের বলা হয়ে থাকে জাতির বিবেক। যখনই কোন জাতি তার ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তখনি, শিল্পীরা সেই সব যৌক্তিক দাবীগুলোতে, তাদের শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সেই সব দাবীগুলোকে করেছে আরো জোরালো এবং তাদের অবস্থানকে করেছে পরিষ্কার। আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৮৯ এর গণ-অভ্যুথান, সব আন্দোলন-সংগ্রামে শিল্পীদের সরব উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই সমাজে শিল্পীদের প্রয়োজনীয়তা। তেমনি, ৮০ লক্ষ মানুষের এই চট্টগ্রাম শহর যখন তার কোন ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নেমেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের, চারুকলা ইনস্টিটিউটের বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরাও সেগুলোতে নিজেদের সামিল করেছে। শিল্প মানুষকে কেবল সৌন্দর্য্য প্রদানই করে না। শিল্প সৌন্দর্য্য প্রদানের পাশাপাশি হতে পারে প্রতিবাদের ভাষাও।

লাল মিয়া একজন আউটসাইডার

শিল্পশিক্ষা লাভ করার পর লাল মিয়ার ঘোর মাথায় চাপছিলো তার শিল্পকর্ম দেখে না, তার বেওয়ারিশ জীবন দেখে। তার ভবঘুরেপনা দেখে। গাছতলায় এলোকেশে তার বাঁশি বাজানোর দৃশ্য দেখে। কিন্তু শিল্পশিক্ষা যখন সান দেয়ার কাজ চলতেছে, তখন আর আগের মত লাল মিয়াকে দেখে মাথার মধ্যে ঘোর হয় না। যেটা হয় সেটা হলো, কষ্ট, বিষাদ, হতাশা। (মহৎ) শিল্প তার স্রষ্টাকে করে তুলে একাকী, (মহৎ) শিল্প তার স্রষ্টাকে সমাজে অবস্থান করার সুযোগ তো দেয়, কিন্তু সমাজের মধ্যে থেকেও তাকে করে তুলে আউটসাইডার।

হ্যাঁ, লাল মিয়া একজন আউটসাইডার।

যেকোন কিছুকে অবজ্ঞা করার যে শক্তি তার ছিলো ছোটবেলা থেকে, সেই চরিত্রটাই মূলত তাকে সাহায্য করছে তার শিল্পের পথ নির্মাণে। কলকাতা আর্ট কলেজের ডিগ্রীটা শেষ করে, একটা সার্টিফিকেট বগলদাবা করে, শিল্প বিস্তারের একটা মধ্যমপন্থা ধারণ করার সম্ভাবনা তার ছিলো। কিন্তু তিনি সেটা করেন নাই, তিনি হাটলেন উল্টা পথে। একাডেমীর শেষ পাঠ না চুকিয়ে, তিনি হাঁটা ধরলেন অজানা গন্তব্যে। চলে গেলেন সিমলার দিকে। ঘুরে ঘু্রে আঁকলেন ছবি, ওই করে জীবিকা নির্বাহ করলেন বেশ কয়েক বছর। ওই সময়ের প্যারিসের প্রথিতযশা শিল্পীদের সাথে প্রদর্শনী করে আসলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে ও কাটালেন বেশ কিছু বছর। এরপর সুলতান ফিরে গেলেন তার জন্মস্থানে, যেখানে হইছিলো তার শিল্পের হাতেখড়ি। সেই চিত্রানদীর পাড়ে। আর দেখতে লাগলেন সব গাঁজাখুরি স্বপ্ন। বাচ্চারা চিত্রা নদীর উপর নৌকা করে ঘুরে বেড়াবে। বনের দুই ধারে খেলা করবে, হরিণ, বানর, বাঘ। আর সেইসব দেখে বাচ্চারা ছবি আঁকবে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত ও হইছিলো। চিত্রার উপর ভসছিলো একটা নৌকা। কিন্তু সে নৌকা গেলো না আর বহুদূর। যাবে কেমনে? স্বপ্নটা যে গাঁজাখুরি।

ছফা তারে আবিস্কার করার আগ পর্যন্ত সে থেকে গেছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে। সংসার ধর্ম করে, বছর বছর সন্তান উৎপাদন করে, পৃথিবীকে ফল-ফসলে ভরিয়ে দেয়ার যে দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা, এসবের আস-পাশ দিয়ে ঘেঁষলেন না লাল মিয়া। ঘর বাঁধলেন পশু-পক্ষীদের সাঙ্গে। আর দেখতে লাগলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটে যাওয়া বিশ্বায়ন ৭০-৮০ র দশকের দিকে এসে কিভাবে কড়া নাড়ছিলো, তার গ্রাম-বাংলার দরজায়। এজন্য সে খুব সযত্নে তার ছবি থেকে বর্জন করলেন আধুনিকতার সে সব উপকরণ, যা করছিলো জীবন ব্যবস্থাকে আপাতপক্ষে সহজ। তার বদলে তিনি স্থান দিলেন, সে সব উপকরণ, যা এই সমাজের তৈরি, যা এখানের মানুষের তৈরি।

৭১ এ যুদ্ধ ঘইটা গেল। বাঙ্গালী দেখলো এক তাণ্ডবলীলা। অস্ত্রের ঝনঝনিতে তান্ডব নৃত্য চললো সারা বাংলায়। এরপরে তিনি লড়াইয়ের ছবি আঁকলেন। কিন্তু সে সব লড়াইয়ে এসব আধুনিক, অস্ত্রসস্থ ছিলো না। ছিলো আদিম অস্ত্র। বর্শা, কাস্তে। আর লাড়ায়ের কারণ গুলোও ওই গ্রাম বাংলার ফেলে আসা বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। সে সব লড়াই চর দখলের লড়াই, সে সব লড়াই ফসলের লড়াই। সুলতান সযত্নে ইগনোর করে গেলনে ঘটমান বাস্তবতাগুলো, তার বিপরীতে সেইসব বাস্তবতাগুলোকে নির্দেশ করলেন যা ক্রমশ ম্রীয়মান। (এরকমা আরো একজনরে আমি চিনি, যিনি যুদ্ধের কেন্দ্রস্থেলে থাইকাও ইগনোর করে গেছেন সেই বাস্তবতাকে। তিনি হইতেছেন পিকাসো। গুয়ের্নিকা ছাড়া পিকাসোর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়া কোন ছবি দেখবেন না। আর গুয়ের্নিকা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আঁকা না, যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর চারেক আগে আঁকা।)

লাল মিয়া জীবন-যাপনে চলায়, বলায়, কওয়ায় ধারণ করতেছিলেন এই গ্রাম-বাংলারে। তিনি এ দেশের কৃষকরে আঁকতেছেন, কিন্তু তিনি কৃষক না। তিনি রাখাল বেশে এলো কেশে বাঁশি বাজাচ্ছেন মাঠের মধ্যে, কিন্তু তিনি রাখাল না। আদতে তার গ্রামের মানুষরা তাকে কখনো বুঝতেই পারে নাই। তার কর্ম-কান্ড দেইখা অনেকে তারে পাগল ভাবতো, অনেকে ভাবতো সাধু সন্ত। তিনি মূলত তার চারপাশের কর্মকান্ড দেখতেছিলেন দূর থেকে দাঁড়াইয়া, আর তার ক্যানভাসে সেগুলো বয়ান করতেছিলেন তার উপলব্ধি থেকে।

তিনি অনুধাবন করতে চেষ্টা করতেছিলেন, কিভাবে আধুনিকতা নিকট উপস্থিত। তিনি তার ছবিতে তো এগুলোর বাদ দিলেন ঠিকই, মুখেও বললেন, “যা আমি অর্জন করিনি, তা আমার না” কিন্তু এই বুলি কি বুঝতে পাড়ছিলো গ্রাম-বাংলার মানুষরা (!)

ছফা তারে এ দেশের শিল্পীসমাজের সাথে পরিচয় করাই দিছিলো ঠিকি, কিন্তু তিনি সেগুলো কখনোই মেনটেইন করেন নাই।গ্রামের ছবি আঁকলেই গ্রাম্য হয়ে যায় না, যে লোক যৌবনে দাবড়ায়া আসলেন কলকাতা, লাহোর, প্যারিস সে লোক গ্রাম বাংলায় গিয়ে পালন করতে পারেন একটা গ্রাম্য জীবন, কিন্তু মন-মনন-মেধার দিক থেইকা সে লোক গ্রাম্য হয় কি?

সে বড়জোড় অনুধাবন করতেন পারেন এসব, আর এরপর তার হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ হয়, তাই তারে করে তুলে একাকী, তাই তারে করে তুলে আউটসাইডার। আর এসকল একাকীত্ব থেকে জন্ম নেয় (মহৎ) শিল্পের।তাই এখন আর সুলতানকে দেখে কোন ঘোর তৈরি হয় না। একাকী হয়ে যাওয়ার যে বিষাদ, যে শূন্যতা, সে বিষাদ, সে শূন্যতাই কেবল কখনো কখনো ছুঁয়ে যায় আমায়।

  • শান্তনু চৌধুরী
  • স্বাধীন লেখক,
  • অধ্যায়নরত , চারুকলা ইন্সিটিউট,
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।